মুম্বাই সিনেমার অত্যন্ত খ্যাতিমান দুই অভিনেতা ও অভিনেত্রী শাহরুখ খান ও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ‘পাঠান’ চলচ্চিত্রে মনোকিনি পরিহিতা দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে হালে উপমহাদেশের নেটিজেনরা তর্কে-বিতর্কে উত্তপ্ত হয়ে উঠছেন। শুধুই ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা ধারণকারী তুলনামূলক ঐতিহ্যবাহী অংশই নন, বাংলাদেশে দীপিকার বহু নারীভক্তদেরও দেখা যাচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত পোশাক ও সেই পোশাকে অভিনেতা শাহরুখের সাথে গানের দৃশ্যের চিত্রায়নে তার অভিনয় মুদ্রার কিছু কিছু দিক নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় ‘খল নায়িকা’ যেমন খুশি পোশাক পরুক, ‘নায়িকা’কে খুব সংক্ষিপ্ত পোশাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। এবং কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে এই বিরোধিতা করতে গিয়ে সামাজিকমাধ্যমে আমার বন্ধু তালিকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশ কয়েকজন ক্রুদ্ধ হয়ে দীপিকার ‘সৌন্দর্য’ নিয়েও নানা কটাক্ষ করতে দেখলাম।
‘মনোকিনি’ পরলেই ‘ভালো অভিনেত্রী‘ হওয়া যায় না জাতীয় মন্তব্য থেকে দীপিকা বড় বেশি শীর্ণকায় বা এমনকি ‘নারীসুলভ’ রূপ-লাবণ্য তার তেমন নেই, এমন মন্তব্যও পড়া হলো।
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র এমনিতেই কম দেখা হয়। তারপরও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত কয়েকটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রর অনেক নাম শুনে তার দু’একটি দেখতে গিয়ে প্রথমে তাকে দেখে খানিকটা বিস্মিত যে হইনি তা নয়। নারীর রূপ সম্পর্কে হালের পশ্চিমা দুনিয়ার শো-বিজ ভুবনের পঞ্চাশ বছরের যেমনটা ধারণা যে ‘সুন্দরী’ নারী হতে হবে অত্যন্ত দীর্ঘ ও শীর্ণকায়, প্রচণ্ড ছিপছিপে সেটা যে এমনকি রানী মুখার্জির সময় পর্যন্ত মুম্বাই সিনেমায় একশো ভাগ মানা হয়েছে তা নয়।
এমনকি হলিউডেও মেরিলিন মনরোর মতো ‘প্লাস ফিগার’-এর নারী প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন বা আজও জনপ্রিয়। কিন্তু বলতে গেলে এক-দেড় দশকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা দীপিকা পাড়ুকোনের মতো অত্যন্ত দীর্ঘ ও শীর্ণকায় নায়িকারাই স্ক্রিনে পরিচালক-প্রযোজকদের কাছে ‘প্রিয়’ হয়ে উঠলেও দক্ষিণ এশিয়ার গড় নারী-পুরুষের মনে নারীর ‘প্রত্যাশিত রূপ’ আসলে ঠিক কেমন?
এমনকি পশ্চিমেও নারীর ‘প্রত্যাশিত’ রূপ আসলে কেমন? ‘প্লাস ফিগার’-এর মেরিলিন মনরো অথবা অত্যন্ত শীর্ণকায় ‘অড্রে হেপবার্ন’—পশ্চিমের নন্দনেও কোন নারী বেশি সুন্দরী বা প্রত্যাশিত? নৃ-তত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, চিত্রকলা তথা মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে নারীর রূপ বিষয়ক ভাবনা কীভাবে বদলেছে যুগ থেকে যুগান্তরে? আসুন, জেনে নিই—
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ : কাম্য নারীদেহ হতে হবে পূর্ণায়তন
ইউরোপে আজ থেকে ২৩,০০০-২৫,০০০ বছর আগের ‘ভেনাস ফিগারিনস’ নামে কিছু ছোট ছোট নারীদেহের ভাস্কর্য পাওয়া যায়। এই ভাস্কর্যগুলোর অন্যতম একটি হলো ‘ভেনাস অফ উইলেনডর্ফ [Venus of Willendorf]’ যা অস্ট্রিয়ার উইলেনডর্ফে ১৯০৮ সালে পাওয়া গেছে। এই ‘ভেনাস’ ভাস্কর্যের আজকের প্রাচ্য-প্রতীচ্যসহ সব দেশের নারী-পুরুষের কাছে কদাকার মনে হলেও সেই যুগে সেটাই ছিল ‘ভেনাস’ বা সৌন্দর্যের ভাস্কর্য।
গোল, নাশপাতির মতো আকৃতি এবং বড় স্তনের এই নারী ভাস্কর্যগুলো আসলে ‘আকর্ষণ’ অথবা ‘উর্বরতা’—ঠিক কোনটির প্রতীক সেটি নিয়ে হালের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তর্ক করছেন।
বাংলাদেশে দীপিকার বহু নারীভক্তদেরও দেখা যাচ্ছে তার সংক্ষিপ্ত পোশাক ও সেই পোশাকে অভিনেতা শাহরুখের সাথে গানের দৃশ্যের চিত্রায়নে তার অভিনয় মুদ্রার কিছু কিছু দিক নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছেন।
প্রাচীন গ্রিসের প্রেম ও রূপের দেবী আফ্রোদিতি [Aphrodite]ও ঠিক আজকের ‘শীর্ণকায়’ রূপবতী ছিলেন না—তার দেহে ছিল ভারতীয় দেবীদের মতোই ‘খাঁজ’ বা সেই একই সরু কোমর তবে ভারী স্তন ও শ্রোণিদেশের নির্ধারিত রূপব্যঞ্জনা।
‘ভেনাস দ্যু মিলো [Venus de Milo]’ নামে জনসাধারণ্যে প্রচলিত তবে মূলত আফ্রোদিতিরই ভাস্কর্য তুলনামূলক ক্ষুদ্র স্তনের হলেও কোমরের বাঁকে তখনো পর্যন্ত নারীদেহের প্রত্যাশিত রূপে ‘কার্ভ’ বা ‘খাঁজ’-এর চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মোটের উপরে প্রাচীন গ্রিসে সুন্দরী নারী বলতে শুভ্রা এবং গুরুবক্ষা নারী বোঝানো হতো। চীনে আবার ‘লোটাস ফিট’ বা ‘পদ্ম পা’-এর নারীদের ‘সুন্দরী’ মনে করা হতো। এই পদ্ম পা করার জন্য অসংখ্য মেয়ের পা শৈশব থেকে এমন কঠিন ব্যান্ডেজে মোড়ানো হতো যে পরবর্তী জীবনে অনেকে স্বাভাবিক হাঁটা-চলা পর্যন্ত করতে পারতেন না। ‘পঙ্গু’ করে দেওয়া এই সৌন্দর্য চর্চা বহুদিন চলেছে চীনে যা আর মাও সে তুং [Mao Zedong] তার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বন্ধ করে দেন।
সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতক অবধি ‘আদর্শ রূপবতী’ নারীর দেহ ‘কার্ভ’ বা ‘বাঁক বিশিষ্ট’ হিসেবেই শিল্পীরা এঁকে গেছেন। সতেরো শতকের ফ্লেমিশ চিত্রকর পিটার পল রুবেন্স [Peter Paul Rubens]-এর অসামান্য সব চিত্রকলায় উপস্থাপিত নারীরা প্রায় সবাই ‘বাঁক বিশিষ্ট’ দেহের অধিকারিণী ছিলেন। ভারী ঊর্ধ্ব ও নিম্নভাগ এবং সরু কোমরের এই নারীদের চিত্রায়িত করার বিশেষ ধরণ রুবেনের নামে চিত্রকলার পরিভাষায় ‘রুবেনেস্ক’ নামে অভিহিত।
রুবেনের চিত্রকলার নারীদের এই রূপ অর্জন করার জন্য অন্ত্য-রেনেসাঁ পর্ব থেকে বিশ শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত ‘কর্সেট’ হয়ে উঠেছিল মেয়েদের একটি জনপ্রিয় অন্তর্বাস। ‘কর্সেট’ পরলে মেয়েদের বক্ষদেশ আরও উঁচু, কোমর আরও সরু দেখাতো এবং রুবেনের চিত্রকলার নারীদের মতো দেখাতো।
১৮৯০ সালে মার্কিন চিত্রশিল্পী চার্লস ডানা গিবসন [Charles Dana Gibson] মূলধারার ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দীর্ঘকায়, সরু কোমর তবে ভারী স্তন ও শ্রোণিদেশের নারী প্রতিকৃতি আঁকার পর এই নতুন ধাঁচের ‘নারী’রূপ ‘গিবসন গার্ল’ বলে অভিহিত করা হতে থাকে।
বিশ শতকের শুরুতেও চিত্রকলায় নারী দেহ ক্রমাগত বদলাচ্ছিল। ফরাসী শিল্পী হেনরি মাতিসেঁ [Henri Matisse]-এর তৈলচিত্রে চটপটে ও ক্ষিপ্র নারীদেহ দেখা যেতে থাকে আবার স্প্যানিশ চিত্রকর পাবলো পিকাসো [Pablo Picasso]-এর চলচ্চিত্রে মেয়েদের নগ্ন দেহগুলো কিন্তু খানিকটা স্থূল ও বিকৃত করে দেখানো হয়েছে। তবে, মোটামুটি ‘বিশ শতক থেকেই ধীরে ধীরে ছিপছিপে ও ক্রীড়াবিদের মতো দেখতে নারীদেহই আকর্ষণীয় নারীদেহ হিসেবে পশ্চিমা সমাজে মান্যতা দেখা দিতে থাকে’ বলে মনে করেন নিউইয়র্কের ‘ফ্যাশন ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ জাদুঘরের ‘পোশাক (কস্টিউম)’ বিভাগের সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক এম্মা ম্যাকক্লেন্ডন [Emma McClendon]।
যদিও ম্যাকক্লেন্ডন নিজেও নিশ্চিত নন যে ঠিক কীভাবে পশ্চিমা সমাজে বিশ শতক থেকে ছিপছিপে নারীদেহের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো, তবে আগ্রহ তৈরি যে হয়েছে এটা ঠিক।
১৯২০-৫০ : নারীর স্তন-কোমর অনুপাতে সামাজিক প্রত্যাশার বদল এবং মেয়েদের ভেতর ‘আহারে অনাগ্রহ’
ভারতে কালিদাসের কাব্য বলুন আর পশ্চিমে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলায় আদর্শ নারীদেহের কোমর দেহের উপরি ও নিম্নভাগের তুলনায় অনেকটা সরু হওয়ার যে প্রচলন ছিল, ১৯২০-১৯৫০ সাল নাগাদ নারীদেহ সবটাই ‘বাঁকহীন’ অতি সরল রেখার মতো ছিপছিপে হবে জাতীয় ধারণার কারণে খুবই ক্ষীণকায় হওয়ার আশায় পশ্চিমে বিশেষত, মেয়েদের ভেতর আহারে প্রচণ্ড অনীহা দেখা দেয়। গণমাধ্যমে যতই ক্ষীণকায় নারীর চলচ্চিত্র ছাপা হতে থাকে, তরুণী মেয়েদের ভেতর আহারে অনীহা যেন মড়কের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৯২০ ও ১৯৮০-র সময় ইতিহাসের দুই সময় যখন আদর্শ রূপবতী নারী বলতে সবচেয়ে ক্ষীণকায় নারী বোঝানো হতো এবং ফলে মেয়েদের ভেতর খাওয়ার প্রতি অনাগ্রহ এই দুই সময়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে, ১৯৯৭ সালে ‘জার্নাল অফ কম্যুনিকেশন’-এর একটি পেপারে ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অফ উইসকন্সিন-ম্যাডিসন’-এর গবেষকরা এমনই লিখেছেন।
যে গৃহবধূ দীপিকা পাড়ুকোনের অভিনয় দেখে খেতে লজ্জিত বোধ করছেন, তার হয়তো সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তার জন্য একজন নাওমি ক্যাম্পবেল বা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের ডায়েট কতটা যুক্তিযুক্ত? এমন ‘ডায়েট’ রোজকার মধ্যবিত্তের জীবনে মেনে চলাও তো দুরূহ।
১৯০১-১৯২৫ সাল নাগাদ ‘ভগ’ এবং ‘লেডিস হোম’ পত্রিকায় প্রচ্ছদ কন্যাদের স্তন ও কোমরে পরিমাপগত দূরত্ব ষাট শতাংশ কমে আসায় বা সোজা বাংলায় ‘বাঁকহীন’ দেহের বদলে সরলরেখার মতো ছিপছিপে দেহ প্রত্যাশিত হতে থাকে বলে ১৯৮৬ সালে সমাজে ‘লৈঙ্গিক ভূমিকা’ বা ‘সেক্স রোলস’ বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে জানানো হয়।
এভাবেই গণমাধ্যমে যতই ছিপছিপে দেহ ‘আকর্ষণীয় নারীদেহ’ হিসেবে প্রচার করা হয়, মেয়েদের ভেতর আহারে অনাগ্রহের রোগও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৪০ নাগাদ জনমনে আবার সেই পুরোনো ‘বাঁক বহুল’ দেহ বা ‘কার্ভি ফিগার’-এর জন্য ব্যাকুলতা দেখা দেয়। গণমাধ্যমের এক-তৃতীয়াংশে পুনরায় স্তন ও কোমরের মাপে দূরত্ব সম্বলিত মডেলদের চলচ্চিত্র ছাপা হতে থাকে। জনচিত্ত জয়ে আবির্ভূত হলেন সরু কোমর তবে ভারী দেহের মেরিলিন মনরো এবং ১৯৫৩ সালে ‘প্লেবয় ম্যাগাজিন’-এর প্রথম সংখ্যায় তার চলচ্চিত্র প্রকাশিত হলো।
১৯৬০-৭০ : আবার ক্ষীণকায় দেহ?
এই দশকে পশ্চিমে নারীবাদের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ দেখা দেবার সাথে সাথে মেরিলিন মনরোর মতো ভারী দেহের ‘প্রত্যাশিত নারী’র বদলে পুনারয় লেসলি লসন বা ‘টুইগি’ নামে পরিচিত শীর্ণকায় মডেলরা আবার ফ্যাশন দিগন্তে উঁকি দিলেন। ‘কর্সেট‘ ও ‘কার্ভি দেহ’-এর বদলে আবার সেই সরলরেখা নারীদেহের বন্দনা!
১৯৬০ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগ’ প্রথম জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারের অনুমোদন দান করে। ১৯৬৩ সালে মার্কিন নারীবাদী আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্ট বেটি ফ্রাইডান [Betty Friedan]-এর ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ প্রকাশিত হয় এবং ১৯৬৬ সালে মার্কিন দেশে ‘দ্য ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওমেন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
যদিও ১৯৬০-১৯৭০ নাগাদ মেয়েদের উপর পশ্চিমে অন্তত; ‘কর্সেট’ পরে কোমর সরু দেখানো বা বাঁক-বহুল দেহবল্লরী প্রদর্শনের চাপ রইলো না, তবু পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ তারা নানা খেয়ালের ঝোঁকে মেয়েদের উপর ‘প্রত্যাশিত নারী সৌন্দর্য’-এর নানা মাপকাঠি অদলে-বদলে চালিয়ে যেতেই থাকলো।
তবে, অতীতের ‘কর্সেট’ বা দীর্ঘ ঝুল-সম্বলিত ‘ঘাগরা’ বা স্কার্টের ক্ষেত্রে যেমন আঁটো-সাঁটো অন্তর্বাস ছিল নারীর রূপ ধরে রাখার একটি প্রচেষ্টা, সেখানে জায়গা নিলো কঠোর ডায়েট এবং ব্যায়াম।
১৯৬০-১৯৭০ সাল নাগাদ পশ্চিমের হাসপাতালগুলো ‘অ্যানেরক্সিয়া নার্ভোসা’ এবং ‘বুলিমিয়া’য় আক্রান্ত নারী রোগীদের চাপে অস্থির হয়ে উঠলো বলে ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘কারেন্ট সাইকিয়াট্রি রিপোর্টস’ থেকে জানা যায়।
১৯৮০-৯০ : সুপারমডেলদের উদ্ভব এবং স্থূলত্ব
আশির দশক জুড়ে পশ্চিমে শীর্ণকায় নারীদের রাজত্বই জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় অব্যাহত থাকলেও পুনরায় ‘সুসমন্বিত’ বা ‘টোনড’ নারীদেহের জন্যও সমাজে প্রত্যাশা ফিরে আসতে থাকে। সিন্ডি ক্রফোর্ড [Cindy Crawford] বা নাওমি ক্যাম্পবেল [Naomi Campbell]-এর মতো মডেলরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
কৃষিভিত্তিক সমাজে নারীদেহ বা সৌন্দর্য তার প্রজনন বা উর্বরা শক্তির সাথে সমর্থক মনে করা হতো বলে আজও প্রাচ্যের সমাজে নারীদেহ খুব ‘শীর্ণকায়’ হিসেবে প্রত্যাশা করা হয় না।
নব্বইয়ের দশক থেকে কিন্তু আবার কেট মস [Kate Moss]-এর মতো শীর্ণকায় মডেলরা জনপ্রিয় হন। ‘কেলভিন ক্লেইন’-এর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কেট মস হয়ে ওঠেন প্রতিটি ঘরের পরিচিতা নাম। কিন্তু অ্যানোরেক্সিয়া বা ‘ক্ষুধাহীনতা’-য় মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে।
এই মৃত্যুর হার এতই বাড়তে থাকেত যে ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই সমস্যার পাশাপাশি স্থূলত্বও কিন্তু সারা পৃথিবীতেই বাড়তে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে পৃথিবী জুড়ে যখন ২০০ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ‘মোটা’ ছিলেন, সেই সংখ্যা ২০০০ সাল নাগাদ ৩০০ মিলিয়নে দাঁড়ায়।
‘স্থূলত্ব’ কতটা মানসিক?
বিশ্ব জুড়ে সুপার মডেল নারীদের অতি শীর্ণকায় দেহ দেখে যে সাধারণ কলেজ ছাত্রীর মনে হলো সে ‘মোটা’ এবং খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলো, তার হয়তো আগামীকাল পরীক্ষা এবং কিছুটা খাওয়া তার প্রয়োজন। যে গৃহবধূ দীপিকা পাড়ুকোনের অভিনয় দেখে খেতে লজ্জিত বোধ করছেন, তার হয়তো সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যে ব্যাংকার মেয়েটি সারাদিন অফিসে ডেস্কে বসে জটিল সব অঙ্কের হিসাবে ব্যস্ত থাকতে হয় অথবা গবেষণার কাজে যে মেয়ে আগামী এক মাস দুর্গম কোনো এলাকায় দিন-রাত ব্যস্ত থাকবে, তার জন্য একজন নাওমি ক্যাম্পবেল বা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের ডায়েট কতটা যুক্তিযুক্ত? এমন ‘ডায়েট’ রোজকার মধ্যবিত্তের জীবনে মেনে চলাও তো দুরূহ।
শুধু নারী নয়, পুরুষ থেকে শিশু-কিশোর-কিশোরী সবার ভেতর এক আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ দেখা যাচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫-৬ বছর বয়সী শিশুদের ভেতর এক-তৃতীয়াংশ শিশু নিজেদের স্থূল মনে করে। সাত বছর বয়সী শিশুদের ভেতর প্রতি চারজনে একজন শিশু খাবারের প্রশ্নে বিচিত্র নানা আচরণ করে।
একজন পাঁচ বছরের শিশুকেও কেন নিজের ‘দেহ’ বা ‘রূপ’ সচেতন হতে হবে? তার তো গোটা জীবন সামনে পড়ে আছে নানা কিছু শিখবার বা ভালো নানা কাজ করার জন্য। আশার কথা এই যে ১৫-১৯ বছর বয়সী একজন কিশোরী খাবারের প্রশ্নে যত অনীহা দেখা দেয়, পরে বাস্তব জীবনের নানা চাপে পড়ে সেই অনীহা কেটে যেতে থাকে।
হালে সামাজিকমাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের দেখা যাচ্ছে পোস্ট করা চলচ্চিত্রে নিজেকে ‘ফিট’ বা ‘সুন্দর’ দেখানোর প্রশ্নে চিন্তিত। তবে, সামাজিক মাধ্যমে বহু সাধারণ নারী নিজেদের ‘সাধারণ’ দেহের চলচ্চিত্র পোস্ট করায় এবং সেসব চলচ্চিত্র খুব অসুন্দর না দেখানোয় ধীরে ধীরে সমাজে সব ধরনের নারীর ‘রূপেরই’ গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
২০০৭-এ কিম কার্দাশিয়ান [Kim Kardashian] এবং তার বোনদের ‘বাঁক-বহুল দেহ’ আবার জনপ্রিয় হতে থাকে। ২০১৫ সালে ‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’-এর স্যুইমস্যুট মডেল হিসেবে রবিন লাওলিকে প্রথম ‘প্লাস সাইজ মডেল’ হিসেবে দেখা দেয়।
২০১৬ সালে ফ্যাশন ডিজাইনার ‘ক্রিস্টিয়ান সিরিজানো’ পাঁচ জন ‘প্লাস সাইজ মডেল’ তাঁর ‘নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইক’-এ পরিচিত করান। খেলনা প্রস্ততকারী কোম্পানি ‘ম্যাটটেল’ বাঁক-সম্বলিত কিছু বার্বি ডলও বাজারে নিয়ে আসে। ২০১৭ সালে ‘প্রজেক্ট রানওয়ে’-তে প্রথম শূন্য থেকে ২২ আকৃতির নানা মাপের নারীদেহের মডেলদের একটি রিয়েলিটি শো অনুষ্ঠিত হয়।
কেন নারীদেহ নিয়ে সমাজে এত নানামুখী চিন্তা?
কৃষিভিত্তিক সমাজে নারীদেহ বা সৌন্দর্য তার প্রজনন বা উর্বরা শক্তির সাথে সমর্থক মনে করা হতো বলে আজও প্রাচ্যের সমাজে নারীদেহ খুব ‘শীর্ণকায়’ হিসেবে প্রত্যাশা করা হয় না। এবং পশ্চিমেও শিল্প বিপ্লব হওয়ার আগ পর্যন্ত নারীদেহ ‘বাঁক-সমন্বিত’ হিসেবে প্রত্যাশা করা হতো।
প্রাচ্য ও প্রতীচ্যসহ সারা পৃথিবী যত শিল্পায়িত হয়েছে এবং কর্ম সংস্কৃতির প্রচণ্ড চাপে যখন পৃথিবী জুড়ে অবিবাহিত, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে এবং পরিবার প্রথা পৃথিবীর নানা জায়গায় ভেঙে যেতে বসেছে, তখন ছিপছিপে নারী যার দেহ ঠিক ‘মাতৃ দর্শণা’ নয় বা যে সন্তান জন্ম দেবে না বা পালন করবে না বলে আপাত দৃষ্টে মনে হয়, তেমন নারীদেহই গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়। কিন্তু তারপরও যেহেতু মানব সভ্যতা টিকে থাকতে হলে বংশরক্ষাও করতে হবে, তাই পশ্চিমেই মেরিলিন মনরো থেকে নাওমি ক্যাম্পবেল হয়ে কিম কার্দাশিয়ানদের মতো ‘বাঁক-বহুল’ নারীদেহের চাহিদা ফিরে ফিরে এসেছে বা আসছে।
বাকি থাকে শাহরুখ খান ‘পাঠান’ চলচ্চিত্রে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন কি না অথবা দীপিকা কেন গেরুয়া রং মনোকিনী (হিন্দুত্বের রং) এবং শাহরুখ কেন সবুজ শার্টে (ইসলামের রং) জাতীয় বিচিত্র সব আলাপ! অথবা দক্ষিণ এশীয় কোনো নায়িকার এত খোলামেলা পোশাকে এবং এমন সব বিভঙ্গে অভিনয় করা উচিত কি না? সেটা আমার চেয়ে বিনোদন সাংবাদিকরাই ভালো বলতে পারবেন।